কোরবানি ঈদের তৃতীয় দিন। প্রকৃতির খেয়ালে ভোর থেকে অঝোরে ঝরেই চলেছে বৃষ্টি। দুপুর থেকে ভাদ্রের কড়া রোদ, ফের অস্বস্তির গরম। ছুটি শেষ, তাই জীবিকার তাগিদে কংক্রিটের শহরে ছুটছে মানুষ। ট্রেনে-বাসে প্রচ- ভিড়। খুলতে শুরু করেছে দোকানপাট। হাতে আরও কয়েকটা দিন থেকে যাওয়ায় আমার যাত্রা তখন উল্টোপথে, নেত্রকোনার মদন উপজেলার উচিতপুর। হাওরবেষ্টিত স্থানটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি। দৃষ্টিসীমায় কেবলই জলরাশি। লিলুয়া বাতাসে একটু কান পাতলেই ঢেউয়ের গর্জন। আর সেই ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুলতে থাকে জেলেদের ছোট ছোট নৌকা।
নেত্রকোনার মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী উপজেলার জনপদগুলো শুকনো আর বর্ষা মৌসুমে রূপ পাল্টায়। শুকনো মৌসুমে হাওড়জুড়ে সবুজের সমারোহ, বর্ষায় অথৈই জলরাশিতে তা কানায় কানায় ভরে ওঠে। ছোট ছোট দ্বীপের মতো একেকটি গ্রাম। সামান্য বাতাস বয়ে গেলেই ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। পরিষ্কার আকাশে সূর্যাস্তের মুহূর্তে জলের বুকে ছড়িয়ে পড়ে সোনালি আভা। রাতের জ্যোৎস্নায় চিক চিক করে বিস্তীর্ণ জলরাশি। জ্যৈষ্ঠ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত হাওড়াঞ্চলটিকে অনেকটাই সমুদ্রের মতো দেখায় বলে অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে ছুটে যান। তাদের নিয়ে ছোট নৌকা আর ট্রলারগুলো দিনভর দাপিয়ে বেড়ায় হাওড়ের বুকে। আশপাশের মানুষজনের কাছে মিনি কক্সবাজার নামেই পরিচিত উচিতপুর।
এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণ ডুবন্ত রাস্তা, জলের বুক ছিড়ে বেশ কিছুটা হেঁটেই যাওয়া যায়। একটু দূরেই বালই সেতু। বর্ষায় অথৈ জলের মাঝে জেগে থাকা দৃষ্টিনন্দন পাকা সেতুটিকে মনে হয় নোঙর করা কোনো জাহাজ। আর দুপাশের অ্যাপ্রোচ সড়কগুলোকে মনে হবে সি-বিচ। উচিতপুর থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে মাত্র ১০ মিনিটেই সেখানে যাওয়া যায়। বিকালে এই সেতুতে বসে দেখা যায় হাওড়ের নতুন রূপ, নীলাকাশ যেন নেমে আসে জলের ডানায়। তাছাড়া দূরের গ্রামগুলোকে মনে হয় ছোট ছোট একেকটা দ্বীপ। পাকা ঘাটের কূল ঘেঁষে দাঁড়ালে দুই পা ভিজিয়ে দিয়ে যায় স্বচ্ছ পানি। অপার আনন্দে তখন নেচে উঠে মন-প্রাণ। ইচ্ছে করলেই কূলহীন হাওড়ের মাঝখানেও যাওয়া যায়। তবে শুকনো মৌসুমে পাল্টে যায় এখানকার সেই দৃশ্য। এ সড়ক দিয়ে তখন ছুটে চলে যানবাহন। কার্তিকের শেষ দিকে পানি সরে যায়। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে শুধুই সবুজ আর সবুজ। এখানকার আঁকাবাঁকা নদ-নদীগুলোতে তখন মিলে বড় বড় রুই, কাতল, চিতল, বোয়াল জাতীয় মাছ। শীতে আসে প্রচুর অতিথি পাখি।
যারা ভাটিবাংলার এই সৌন্দর্যের সবটুকু উপভোগ করতে চান তারা ঘুরে আসতে পারেন। সেখানকার সহজ-সরল মানুষগুলো খুবই অতিথিপরায়ণ। তবে রাতযাপনের কোনো সুবিধা নেই উচিতপুরে। মদন সদরে একটি ডাকবাংলো এবং আবাসিক হোটেল রয়েছে। যদিও ততটা মানসম্মত নয়। একটু ভালোভাবে থাকতে চাইলে যেতে হবে নেত্রকোনা কিংবা কেন্দুয়ায়। অবশ্য জলখাবারের কোনো অসুবিধা নেই উচিতপুরে। বেশ কিছু দোকানপাট গড়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্রটি ঘিরে। হোটেলগুলোতে পাওয়া যায় হাওড়ের তাজা মাছ। নিরাপত্তার জন্য রয়েছে পুলিশ।
জেলা শহর থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে মদন উপজেলা সদর। সেখান থেকে ৪ কিলোমিটার পূর্বে উচিতপুর হাওড়। চমৎকার পিচঢালা পথে নেত্রকোনা থেকে উচিতপুর আসতে সময় লাগে এক থেকে সর্বোচ্চ দেড় ঘণ্টা। বাসে করে মদন আসতে লাগে ৫০ টাকা। বাস স্টপেজ থেকে মদন বাজার ১০ টাকা অটোরিকশা ভাড়া। সেখান থেকে অটোরিকশা দিয়ে উচিতপুর যেতে লাগবে আরও ৩০ টাকা ভাড়া। আবার মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে মদনে যেতে ভাড়া লাগবে ৩৫০ টাকা। ঢাকা থেকে উচিতপুর পর্যন্তও রাতে একটি বাস চলে।
উচিতপুর পর্যটন সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি মো. শামছুল আলম তালুকদার জানান, স্ব-উদ্যোগেই স্থানীয়রা পর্যটকদের সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এখানকার সৌন্দর্যের কথা ছড়িয়ে পড়ায় দিনদিনই লোকসমাগম বাড়ছে। তাই উচিতপুরকে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে সামান্য কিছু উদ্যোগ প্রয়োজন। বিশেষ করে দূর-দূরান্তের পর্যটকদের রাতযাপনের জন্য একটি আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। সেই সঙ্গে দরকার ঘাট থেকে বালই সেতু পর্যন্ত বিরামহীন ট্রলারের ব্যবস্থা করা। এতে ভ্রমণপিপাসুরা কম খরচে যাতায়াত করতে পারবেন।
মদন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ওয়ালীউল হাসান জানান, উচিতপুরকে সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমরা নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি। বেশ কিছু উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থাও। আর এ কারণেই বিপুল পরিমাণ পর্যটকের সমাগম হয়েছে এবার।
ওবায়দুল্লাহ সনি, মদন থেকে ফিরে
**রাজনৈতিক, ধর্মবিদ্বেষী ও খারাপ কমেন্ট করা থেকে বিরত থাকুন।**